লেখকঃ শারমিন আহমদ
প্রকাশঃ প্রথম আলো, ১০ এপ্রিল ২০২১
২৬ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাসহ তাঁর জীবনকর্মের ওপর বিস্তর লেখালেখি, তথ্যউপাত্ত আমরা পাই। কিন্তু তিনি যখন পাকিস্তানের জেলে, তাঁর অবর্তমানে তাঁরই বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদ এবং তাঁর সহকর্মীরা যে অসীম নিষ্ঠা, ত্যাগ, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতার সঙ্গে সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস কোথায়? স্কুল–কলেজের পাঠ্যপুস্তক পড়ে আজকের প্রজন্ম জানতেই পারবে না সেই ক্ষণজন্মা অগ্নিপুরষদের পর্বতপ্রমাণ ত্যাগ ও অবদানের কথা। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড, অনুষ্ঠান, আলোচনা ও আয়োজনে কী এক রহস্যময় কারণে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই সরকারের ওপর আলোকপাতের বিষয়টি ঊহ্য থেকে যায়; স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তি হলো তাঁদের এবং স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত পুরোধা ব্যক্তিদের যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে স্মরণ করা বাদেই। এতে আমাদের জাতির গৌরব বাড়েনি।
গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকারের (যা মুজিবনগর সরকার নামেই সমধিক পরিচিত এবং যার নামকরণটিও তাজউদ্দীন আহমদেরই করা) বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ব্যতীত মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন যে কত দুরূহ ছিল, তা সেদিনের ইতিহাসকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন এবং সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে বস্তুনিষ্ঠভাবে বিষয়টিকে পর্যালোচনা করেছেন, তাঁরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের মৌলিক উপাদান, ভূখণ্ড, জনগণ, সরকার ও সার্বভৌমত্বের মধ্যে সুনিপুণ বন্ধন ঘটেছিল এই সরকারের দূরদর্শী নেতৃত্বে।
১৯৭১–এর ২৫ মার্চ রাতে, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর দুর্গম যাত্রালগ্নের সাথি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে স্বাধীনতার সংকল্প নিয়ে, বাসস্থান ছেড়ে চলে যান। তাঁরা আত্মগোপনে যাওয়ার পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ওনার বাড়ি আক্রমণ করে। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন উর্দুভাষী ভাড়াটে সেজে কোনোমতে রক্ষা পান। পরদিন পেছনের দেয়াল টপকে প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তাঁর বড় ভাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের সমর্থক মুসা সাহেব বেগম তাজউদ্দীনের কাছে পৌঁছে দেন তাঁর স্বামীর চিরকুট। মুক্তার মতো অক্ষরে লেখা ওই ক্ষুদ্র বার্তার গভীরে ছিল এক নতুন ইতিহাসের সূচনা।
‘লিলি (সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন) আমি চলে গেলাম। যাওয়ার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না...মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও। দোলনচাঁপা।’ (ছদ্মনাম)
তাজউদ্দীন তাঁর পরিবারকে সাড়ে সাত কোটি মানুষ থেকে পৃথক করে দেখেননি। আর সাধারণের বেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়া জোহরাও সেদিন খুঁজছিলেন এক অসাধারণ মানুষকে—তাঁর স্বামীকে।
পাকিস্তান মিলিটারির মরণ হামলা থেকে কোনোমতে জীবন বাঁচিয়ে, ঢাকা শহর ছেড়ে চার নাবালক সন্তান নিয়ে জোহরা তাজউদ্দীন প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলেন স্বামীর পৈত্রিক ভিটা গাজীপুরের দরদরিয়া গ্রামে। সেখানেও আক্রমণ শুরু হলে তিনি গ্রাম ত্যাগ করে আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরতে থাকেন অন্যান্য গ্রামে। সে অন্য ইতিহাস।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের রাতটি ছিল একেবারেই ভিন্ন। জোনাকির আলো, ঝিঁঝির অবিরাম মূর্ছনা আর শাল–গজারি বনের উত্তাল কম্পনকে অতিক্রম করে বিদ্যুৎবিহীন গ্রামটি সে রাতে জেগে উঠেছিল অন্য আলোয়। কোলকাতার আকাশবাণী থেকে বারবার প্রচারিত হচ্ছিল যে রাত ১০টায় একটি বিশেষ সংবাদ প্রচারিত হবে। রেডিওতে কান পেতে জোহরা তাজউদ্দীন, আর তাঁকে ঘিরে সবাই। তাঁর স্বামীর সহোদর মফিজউদ্দীন আহমদ বাইরের বাংলা ঘরে লোকজন নিয়ে রেডিও শুনছেন। রাত ১০টায় সবাইকে বিস্ময়, আনন্দ ও ভাবাবেগে আপ্লুত করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দৃঢ় প্রত্যয় ভরা উদীপ্ত কণ্ঠ ইথারে ভেসে এল:
‘স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবোনেরা, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিবাদন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাঁদের, যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাঁদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন।…বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি, তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের জন্যে। এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে…স্বাধীনতার জন্যে যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হবার জন্যে নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিবার গোষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য।’
হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামের মধ্যেও তাঁর প্রথম ভাষণেই বন্ধু রাষ্ট্রকে স্মরণ করিয়ে দিলেন নিজ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানকে।
এই ঐতিহাসিক সুদীর্ঘ ভাষণটির সমাপ্তি পর্বে ধ্বনিত হয় নতুন প্রত্যুষের দিগন্ত আলোকিত স্বপ্ন ও প্রতিজ্ঞা। তিনি বলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসূ হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হোক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শোষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক ক্ষুধা, রোগ, বেকারত্ব ও অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়োজিত হোক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালি ভাইবোনের সম্মিলিত মনোবল ও অসীম শক্তি। যাঁরা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছেন বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাঁদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তি প্রস্তরে লেখা হোক “জয় বাংলা”, “জয় স্বাধীন বাংলাদেশ”।’
প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের সুচিন্তিত ও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনাবাহী বক্তব্য থেকে দেশবাসী জেনে যায় ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠার কথা। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধে শক্তির সঞ্চার ঘটে এবং বিজয়ের পথ সুগম হয় এই সরকারের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম রচিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রর ভিত্তিতে এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মতিসহ আইনানুগভাবে প্রতিষ্ঠিত এই নতুন সরকারের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপরাষ্ট্রপতি এবং (পাকিস্তান কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে) ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে পাড়ি দিতে হয় পিচ্ছিল সর্পিল পথ। মোকাবিলা করতে হয় জটিলতর পরিস্থিতি। বাইরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হামলা, ভেতরে খন্দকার মোশতাকের পাকিস্তান ও সিআইএর পক্ষ হয়ে কনফেডারেশন গঠন, তাঁকে হত্যাচেষ্টাসহ, নানা স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকে তিনি বিচক্ষণতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সাহস দিয়ে বানচাল করেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রেখে নিশ্চিত করেন পাকিস্তান কারাগার থেকে জাতির পিতার নিঃশর্ত মুক্তি। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে ভারতের স্বীকৃতি অর্জন এবং দেশকে হানাদারমুক্ত করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ যে স্থান করে নেয়, তার বিরল কৃতিত্বও এই সরকারেরই।
শারমিন আহমদ তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের জ্যেষ্ঠ কন্যা