** ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে একজন পাকিস্তানির বাঙালীদের পক্ষ নেয়ার গল্প!
থমথমে বাংলাদেশ, ১৯৭১। ঢাকার গোপীবাগ আরও অশান্ত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় গন্তব্যহীন মানুষের ছুটে চলা—কোথায় গেলে বাঁচবে প্রাণটা। আশার আলো দেখতে না পাওয়া কিছু মানুষ জীবনের মায়া ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে থেকে গেলেন গোপীবাগের নিজ ভিটেতেই। কতটা সৌভাগ্যবান-ই না ছিলেন তারা, তাদের জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন এক পাকিস্তানিই। অবাক লাগছে, তাই না!
সিনেমার গল্প নয়, সত্যি। মানুষটি ছিলেন পাকিস্তান জাতীয় দলের ফুটবলার আবদুল গফুর বালুচ। পাকিস্তানি হয়েও এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানের অত্যাচার মেনে নেননি। তাঁর সমর্থন ছিল এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতি। ১৯৫৮ সালে ফুটবলের কাবুলিওয়ালা ট্যাগ নিয়ে এসে সেই যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নাড়ি-নক্ষত্রের সঙ্গে বন্ধন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলার সঙ্গে অবাঙালি গফুরের প্রেমের সম্পর্ক গভীর থেকে হলো আরও গভীরতম। আর শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের বালুচ সম্প্রদায়ের মানুষটি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিকেই বানিয়েছিলেন তাঁর অহংকৃত ও শেষ আপন ঠিকানা।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত আগা খান গোল্ডকাপ খেলতে ১৯৫৮ সালে প্রথম ‘বাংলায়’ পা রাখেন পাকিস্তান দলের অধিনায়কত্বের অভিজ্ঞতা থাকা এই ডিফেন্ডার। এর পর থেকেই শুরু হয় ফুটবলার গফুরের ‘বাংলাদেশি’ হয়ে ওঠার গল্প। পূর্ব পাকিস্তানে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ওয়ান্ডারার্সের জার্সিতে। ষাটের দশকে যে ফুটবল উপহার দিয়েছেন, সে গল্প এখনো কোনো ক্ষুরধার মস্তিষ্কের ফুটবল প্রেমীর মুখ থেকে শোনার সৌভাগ্য হলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মও আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে গফুরের ফুটবল শৈলীতে। তবে একজন গফুর খেলার মাঠ ছাপিয়ে বাংলাদেশিদের হৃদয়ে নায়কের আসনে বসে আছেন পাকিস্তানি থেকে বাংলাদেশি হয়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে।
বাংলাদেশের মাটি, এখানে দীর্ঘকালীন অবস্থান, ওয়ান্ডারার্সের জার্সিতে খেলা, ব্রাদার্স ইউনিয়নের ওস্তাদ, যুব সম্প্রদায়ের প্রতি অবাধ মমত্ববোধ। বিশেষ করে গোপীবাগ পাড়ার প্রতি তাঁর টান ছিল রক্তে। আর বাঙালি-অবাঙালি ভেদ-বিচারে অক্ষম একজন খেলোয়াড়ি মনোভাব পৃথক পরিচয়টা পোক্ত করে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, অনেক ভালো মন্দের বিশ্লেষণই তাঁর এই স্বাধীন বাংলাদেশ ঠিকানা। গফুরের সেই ‘বাংলাদেশি’ সত্তাকে ১৯৮০ সালে নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মান জানিয়েছিল বাংলাদেশ।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় পরিচয়। ফুটবলার পরিচয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে পরিচিত হয়েছিলেন ‘ব্রাদার্সের ওস্তাদ গফুর’ হিসেবে। স্বাধীনতার উষা লগ্নে তাঁর হাত ধরে আগুনের দীপ্তিময় গোপীবাগের সোনালি প্রজন্মের ব্রাদার্স গড়ে ওঠা। ফুটবলীয় ক্ষুরধার মস্তিষ্কের পরীক্ষা দিয়ে পেয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচের দায়িত্বও। জীবনের শেষ অধ্যায়ে চিরকুমার গফুরের নিঃসঙ্গ জীবনের শেষ নিশ্বাস এই বাংলার মাটিতেই এবং শুয়ে আছেন তাঁর প্রিয় গোপীবাগেই।
১৯৯৭ সালের ২৫ জুনের সকালটা সবে দুপুরে গড়াতে শুরু করেছে। গফুর বালুচ নেই-খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই ডুকরে কেঁদে উঠে বাংলাদেশ। বাংলার মাটিতে তাঁর শেষ নিশ্বাসের খবরটি সীমান্তর কাটা তার ভেদ করে তাঁর জন্মভূমি পাকিস্তানে বিষাদ এনে দিয়েছিল কিনা, জানা নেই। কেউ জানার প্রয়োজনও অনুভব করেননি। তবে মৃত্যু নামের সত্যটিকে কষ্ট করেই মেনে নিতে হয়েছিল বাংলাদেশকে।
সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও বাংলাদেশ অধ্যায়ঃ
১৯৩৬ সালে করাচিতে জন্মগ্রহণ করেন গফুর বালুচ। শোনা যায় মায়ের দিক থেকে তিনি ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। ১৯৫১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই করাচির কাদরি স্পোর্টস ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগ লিগে খেলোয়াড়ি জীবন শুরু হয় তাঁর। ফুটবলার হিসেবে খ্যাতি প্রতিষ্ঠা সবই পেয়েছিলেন করাচিতে। জাতীয় দলের রক্ষণভাগের অপরিহার্য খেলোয়াড় ছিলেন, পাকিস্তান দলকে নেতৃত্বও দিয়েছেন এই সেন্টারব্যাক। ১৯৫৮ সালে করাচি কিকার্স দলের হয়ে আগা খান গোল্ডকাপে খেলতে প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসা।
১৯৫৯ সালের ওয়ান্ডারার্সের জার্সিতে ঢাকা লিগে অভিষেক। টানা সাত মৌসুম খেলেন ওয়ান্ডারার্সে। ১৯৬৬ সালে ইপিআইডিসিতে (বর্তমানে বিজেএমসি) যোগ দিয়ে দলটিকে ১৯৬৭-৬৮ সালে লীগ চ্যাম্পিয়ন করেন। পরের বছর আবার ফিরে যান ওয়ান্ডারার্সে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে শেষবারের মতো জার্সি গায়ে চাপিয়েছিলেন কিছুক্ষণ সময়ের জন্য। সে বছর ছিলেন মূলত বিআইডিসি নামের দলটির কোচ। কিন্তু শেষ খেলায় জার্সি গায়ে চাপিয়ে মাঠে নেমে অবসর। সে বছর দলটি হয়েছিল চ্যাম্পিয়নও।
এরপর থেকেই শুরু হয় ‘গফুর ওস্তাদ’ যুগ। ব্রাদার্স ইউনিয়নের একেবারে শুরু থেকেই পালন করেন কোচের দায়িত্ব। তিল থেকে শুরু করে ব্রাদার্স ইউনিয়নকে বানিয়েছিলেন দেশের তৃতীয় সেরা ক্লাব। তাই দেশের ফুটবল অনুরাগীরা তাঁকে বেশি চিনেছে ‘ব্রাদার্সের গফুর বালুচ’ হিসেবে। ব্রাদার্স ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে কোচিং করিয়েছেন বিআইডিসি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বিজেএমসি, সাধারণ বিমা ও ওয়াপদা ফুটবল দলকে। কোচিং ভান্ডারে মণি মুক্তার মতো শোভা পাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হওয়ার কৃতিত্বও।
ফুটবলের টানে বিয়ে করা হয়নি। সংসারী না হয়েও তিনি সংসার করেছেন ফুটবলের সঙ্গে, নিঃসন্তান হয়েও যিনি সন্তানদের খুঁজেছেন ফুটবলারদের মাঝে, সেই গফুর এ দেশের ফুটবলকে উপহার দিয়েছেন অনেক ফুটবলার।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ভূমিকাঃ
বুদবুদে হয়ে জমতে থাকা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে গফুরের পরিচয় ১৯৫৮ সালে। যিনি নিজেই নিজের বিচার বুদ্ধি ও পেশাগত পরিকল্পনাকে বাংলাদেশের জলবায়ুর কাছে সমদিত করলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় করাচিতে ফিরে না গিয়ে পরোক্ষভাবে কাজ করলেন বাংলাদেশের হয়েই। থাকতেন গোপীবাগের ভূত বাংলায় (বর্তমানে আনসার ক্যাম্প।) গোপীবাগের অনেক মানুষ আছে যাদের পাকিস্তান আর্মির হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় পরিচয়টাই পাকিস্তান আর্মির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন গোপী বাগবাসীকে বাঁচানোর জন্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গফুরের ভূমিকা সম্পর্কে ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ হাসানুজ্জামান বাবলু বলেন, ‘গফুর ওস্তাদ গোপীবাগে থাকতে থাকতে স্বাধীনতা যুদ্ধ লাগল। যুদ্ধের সময় গোপীবাগের অনেক মানুষকে বাঁচিয়েছেন ওস্তাদ। তিনি যে পাকিস্তান জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিলেন, সেই পরিচয়ের জোড়েই দিয়েই পাকিস্তান আর্মিকে মোকাবিলা করতেন। গোপীবাগের মানুষ তাঁর এই ঋণ কখনোই ভুলবে না।’
ব্রাদার্স দলের সাবেক অধিনায়ক ও গোপীবাগেরই সন্তান শহীদউদ্দিন আহমেদ সেলিমও বলেন, ‘খোকা (সাদেক হোসেন খোকা) ভাইয়ের মুখ থেকে অনেকবার শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় গফুর ওস্তাদ তাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ওস্তাদের বাসাতেই রাখা হতো। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার ব্যবস্থাও করতেন।’
১৯৭৩ সালে গফুর নিজেও শহীদউদ্দিনকে বলেছেন, ‘আমার সঙ্গে খেলা এক পাকিস্তানী আর্মি অফিসার আমাকে সব সময় সন্দেহ করত, ও আমার কাছে এসে বলত আমি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছি। রুমে ঢুকে উঁকি দিত, কিন্তু কখনো কঠোরভাবে চেক করত না।’