স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী, শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারকে।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার
একাত্তরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাঁর কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু তাঁকে আমরা বাঁচিয়েও রাখিনি। স্বাধীন ও সার্বভৌম সেই রাষ্ট্রেই তাঁকে হত্যা করা হয়, যে রাষ্ট্র অর্জনের জন্য তিনি প্রবল বিক্রমে লড়েছিলেন ও লড়াই করিয়েছিলেন অগণিত দুঃসাহসী গেরিলা যোদ্ধাকে।
হ্যাঁ, বলছি মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারের কথা। এ,টি,এম, হায়দার অথবা মেজর হায়দার নামেই যাকে আমরা চিনি।
মো. ইসরাইল মিয়া ও হাকিমুন্নেসার পুত্র এটিএম হায়দারের জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে, ১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে হায়দারের স্থান দ্বিতীয়। পাবনা জেলার বীণাপানি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ১৯৫৮ সালে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ১৯৬১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৬৩ সালে লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেন।
লাহোরের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে পরিসংখ্যানে এমএসসি প্রথম পর্ব সমাপ্তির পর সামরিক বাহিনীতে কমিশন্ড পদে মনোনীত হন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি প্রথমে কাকুলে ট্রেনিং নেন এবং কমিশন প্রাপ্তির পর গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার হিসেবে নিয়োজিত হন। চেরাটে এমএসজি (স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ) ট্রেনিংয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে একজন দক্ষ গেরিলা কমান্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
কমান্ডো ট্রেনিংয়ে ৩৬০ জনের মধ্যে মাত্র দুজন বাঙালি অফিসার ছিলেন। কমিশন প্রাপ্তির পর ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতান ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে তাঁকে কুমিল্লা সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ১৫-২০ দিন পর পুনরায় কুমিল্লায় নিয়োগ করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস ত্যাগ করেন এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখান থেকে তিনি তেলিয়াপাড়া যান এবং কিছু সংখ্যক সৈন্যসহ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তিনি ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কসহ মুসল্লী রেলওয়ে সেতু বিস্ফোরকের সাহায্যে উড়িয়ে দেন। এরপর তিনি মেলাঘরে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের অধীনে সেকেন্ড কমান্ডার নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন হায়দার মেলাঘরে ছাত্রদের নিয়ে একটি কোম্পানি গঠন করেন এবং গেরিলাদের কমান্ডো ও বিস্ফোরক বিষয়ক প্রশিক্ষণ দানের দায়িত্ব পালন করেন।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সফলতম কৌশল প্রণেতা ছিলেন তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ, তাঁর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কম্যান্ডো ক্যাপ্টেন হায়দার (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন)।
তাঁদের পরিচালিত, স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর দুই ছিল গেরিলা যোদ্ধা গড়া ও পরিচালনার সূতিকাগার। মেজর হায়দার ছিলেন গেরিলা যোদ্ধা তৈরির প্রধান কারিগর। বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ভূমি থেকে উঠে আসা পলিমাটি মাখা হাজার হাজার তরুন-যুবক'দের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি। আজ অবিশ্বাস্য মনে হবে, কিন্তু এই মহান যোদ্ধা মাত্র কয়েক মাসে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ৩৫ হাজার গেরিলাকে। যাঁদের অনেকেই রাজধানী ঢাকা এবং সেক্টর দুইয়ের অধীন এলাকা ছাড়াও অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ত্রাস হয়ে আবির্ভূত হয়েছিল।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান নিয়ে আমাদের বলার কিছু নেই। সেক্টর ২ এর অধীনে পরিচালিত গেরিলা অপারেশনগুলো এবং তাঁর হাতে গড়া গেরিলা'গণ সেই উজ্জ্বলতম অবদানের সাক্ষ্য হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জাজ্বল্যমান। মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাসে স্বাধীনতা নামে যে ছবিটি আঁকা হয়েছে একাত্তরের ৯ মাস জুড়ে, মেজর হায়দার ছিলেন সেই ছবির অন্যতম জ্যোতির্ময় শিল্পী।
সৈয়দ মাশুক আহমেদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। মেজর হায়দারের কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই যোদ্ধা যুদ্ধ শেষেও মেজর হায়দারের বড় বোন আখতার বেগমের ঢাকার বাসায় আসা যাওয়া করতেন। মুক্তিযোদ্ধা মাশুক স্বাধীনতার পর পূবালী ব্যাঙ্কে কর্মরত ছিলেন। এক বিকেলে চা পানের সময় মেজর হায়দার হাসতে হাসতে মাশুককে বললেন,'কি মাশুক, ডিআইটি বিল্ডিং'র মতো দুয়েকটা বিল্ডিং আমাদের হতে পারতো না?'
মাশুক জবাবে বললেন, 'কি বলেন হায়দার ভাই! আপনার হুকুমেই তো বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকার বস্তাগুলো টেনে নিয়ে স্ট্রং রুমে ঢোকালাম। আর এখন আমি পূবালী ব্যাংকে কেরানির চাকরি করি! আপনি কোন কিছু ধরলেন না, আমাদেরও কোন কিছু ধরতে দিলেন না'।
(★★ সৈয়দ মাশুক আহমেদ পঁচাত্তরের ৬ নভেম্বর রাতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হায়দারের সাথে ঢাকা সেনানিবাসে প্রবেশ করেন বলে জানা যায়। এরপর থেকে আজ অবধি তাঁর কোন খোঁজ মেলেনি)
১৯৭৫ সালের রক্তস্নাত দুঃসময়ে ৭ নভেম্বর নৃশংসভাবে হত্যার পর, মেজর হায়দারকে কিশোরগঞ্জে সমাধিস্থ করা হয়। এর কয়েকদিন পর তাঁর বাড়ি থেকে আনুমানিক ৭-১০ মাইল দূরের গ্রাম থেকে এক কিশোর ছুটে এসে তাঁর সমাধির সামনে কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়ে। সেই ছেলেটির পড়াশোনার খরচ চালাতেন মেজর হায়দার। পঁচাত্তরে সেই কিশোর আইএসসি পড়তো, হায়দারের মৃত্যুর পর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতিটি মানুষ একেকটি ইতিহাস। প্রতিটি মানুষ একটি বাড়ির মতো, বাইরে থেকে দেখতে একরকম, ছাদের ওপর থেকে একরকম, বাড়ির ভেতর আরেকরকম। একসাথে একটি পুরো বাড়ি যেমন দেখা সম্ভব নয়, একইভাবে একটি মানুষকেও কখনো কোনদিন কারও পক্ষেই একসাথে উপলব্ধি করাও অসম্ভব প্রচেষ্টা।
কিংবদন্তী মেজর হায়দারের প্রতি হৃদয় গভীরের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি।
তথ্য সুত্রঃ আখতার বেগম (মেজর হায়দারের বড় বোন)
গেরিলা যোদ্ধা মরহুম জহিরুল ইসলাম।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দারের তিনটি ছবিই স্বাধীনতার কিছুদিন পর রাজধানীর গুলশান পার্কে তুলেছিলেন, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রদ্ধেয় সাইফ ইমাম জামী।