১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী আন্দোলন



পাকিস্থান সৃষ্টির পর পরই রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে প্রশ্নে এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগঠিত হয়। তবে এ আন্দোলন বিনা কারনে হঠাৎ করে এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। ১৯৪৭ সালের মে মাসে হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত এক উর্দূ সম্মেলনে সভাপতির ভাষনে কেন্দ্রিয় মুসলীম লীগ নেতা চৌদুরী খালেকুজ্জামান ঘোষনা করেন যে,“উর্দূই হবে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা।” একই বছরের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড: জিয়া উদ্দীন আহমেদও উর্দূর পক্ষে একই মত প্রকাশ করেন। এ সময়ে ভাষাতাত্ত্বিক ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ “আমাদের ভাষা সমস্যা” শিরোনামে এক প্রবন্দ্বেƒ ড: জিয়া উদ্দীনের বক্তব্য খন্ডন করে ভাষার পক্ষে জোড়ালো যুক্তি তুলে ধরেন। একই ভাবে পাকিস্থান প্রতিষ্ঠার পূর্বে পাকিস্থান রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়।

১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট সৃষ্টি হলো পাকিস্থান নামক একটি দেশ। পকিস্থান সৃষ্টির ৭ দিন পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুন শিক্ষক আবুল কাশেমের নেতৃত্তে তিন সদস্য বিশিষ্ট্য “তমুদ্দুন মজলিস” গঠিত হয় যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু এ দাবী পাকিস্থানী শাষকগোষ্ঠি প্রত্যাখ্যান করে







১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান গণপরিষদে প্রথম অধিবেসনে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দূ ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা কে পরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসাবে গ্রহনের প্রস্তাব আনুষ্ঠানিক ভাবে উত্থাপন করেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রি লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবের বিরোধীতা করে বলেন, পাকিস্থান মুসলিম রাষ্ট্র হওয়ার দরূন উর্দূই পাকিস্থান একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে পরে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গঠিত পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগ এক ইস্তেহারে বাংলা ভাষার বিরুদ্বেƒ এরূপ ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯ মার্চ তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্থান সফরে আসেন। তার তিন দিন পর ২১ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় ঘোষনা করেন, “উর্দূ এবং উর্দূই হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” তাৎক্ষনিক ভাবে এ ঘোষনার প্রতিবাদ জানানো হয়। এর ৩ দিন পর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই ঘোষনার পুনরাবৃত্তি করলে উপস্থিত ছাত্ররা এ ঘোষনার তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং শ্লোগান দেয় “না না বাংলাই হবে পাকিস্থানের রাষ্টভাষা।” ঢাকায় অবস্থান কালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ছাত্রদের সাথে ভাষা ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে একাধিকবার বৈঠকে বসে কিন্তু ভাষার প্রশ্নে তিনি আপোষ করতে রাজী হননি।



১৯৫০ সালে পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রি লিয়াকত আলী খান গনপরিষদে পাকিস্থানের ভবিষ্যত সংবিধান সস্পর্কে মূল নীতি কমিটির রিপোর্টে উর্দূকে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী করলে পূর্ব বাংলার জনগন তা প্রত্যাখ্যান করে। এ দিকে ১৯৫১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলা ভাষাভাষি লোকের সংখ্যা ছিল শতকারা প্রায় ৫৪.৬ ভাগ এবং উর্দূ ভাষাভাষির লোকের সংখ্যা ছিল শতকারা মাত্র ৬ ভাগ। পাকিস্থানি শাসকগোষ্ঠি অন্যায় ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের ভাষাকে পদদলিত করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করকে চেয়েছিল।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারী তৎকালীন পাকিস্থানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানের এক জনসভায় ঘোষনা দেন, “উর্দূই হবে পাকিস্থানের রাষ্টভাষা।” ফলে ছাত্র-শিক্ষক বুদ্দি¦জীবী মহলে দারুন ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করে। আন্দোলনের অংশ হিসাবেই ৩০ জানুয়ারী ঢাকায় সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়ওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পর দিন ৩১ জানুয়ারী ঢাকার বার লাইব্রেরী হলে কাজী গোলাম মাহাবুব কে আহবায়ক করে আওয়ামী মুসলিমলীগ, যুবলীগ, খিলাফত-ই-রাব্বানী পার্টি, ছাত্রলীগ, ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের নিয়ে একটি সর্ব দলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় “সর্ব দলীয় সংগ্রাম পরিষদ” গঠিত হয়। এ সভায় স্থির হয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারী প্রদেশব্যাপী “রাষ্ট্রভাষা দিবস” পালন করা হবে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়রী রাষ্ট্রভাষা দিবস কর্মসূচী কে সফল করে তুলার জন্য ৪ ফেব্রুয়ারী হরতাল এবং ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারী সাফল্যের সাথে “পতাকা দিবস” পালিত হয়। কারাগারে আটক অবস্থায় ১৬ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামীলীগ নেতা মহি উদ্দিন আহমেদ আমরন অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। অন্যদিকে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” ব্যাজ বিক্রি করে ২১ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের জন্যে ছাত্র-ছাত্রীরা অর্থ সংগ্রহ শুরু করে।
নুরুল আমিনের ক্ষমতাসীন সরকার ২০ ফেব্রুয়ারী এক আকষ্কিক ঘোষনার মাধ্যমে বিকেল থেকে ঢাকা শহরে পরবর্তী একমাসের জন্যে ১৪৪ ধারা জারী করে সকল প্রকার সভা, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন। সংগামী ছাত্রসমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভযাত্রা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।

পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারী তারিখে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ছোট ছোট শোভাযাত্রা সহ ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের পুরানো কলা ভবন প্রঙ্গনে মিলিত হয়। ছাত্র নেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্ত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন প্রঙ্গনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শোভাযাত্রা সহ মায়ের ভাষা বাংলা কে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করার জন্য প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে গেটের সশস্র পুলিশ প্রহরা ভেদ করে অসংখ্য দলে দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা শান্তিপূর্ন ভাবে এগিয়ে চলতেে থাকে। মুখে ছিল তাদের একটাই শ্লোগান, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।” শান্তিপূর্ন এ মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে পৌছালে পুলিশ গুলিবর্ষন সহ নির্বিচারে লাঠিচার্জ শুরু করলে রফিক, শফিক, সালাম, বরকাত ও জব্বার সহ নাম না জানা অনেক তরুন তরুনী নিহত হয় এবং ক’য়েক শ ছাত্র-ছাত্রী আহত হয়। বাংলার জাতীয় ইতিহাসে রচিত হয় এক রক্তাক্ত অধ্যায়।